Information

কোমর ব্যথার কারণ এবং দূর করার উপায়

দ্রুত কোমরের ব্যথা সারানোর ৭ ঘরোয়া উপায়

কোমর ব্যাথা একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা যা যেকোনো বয়সের মানুষের হতে পারে। কোমর ব্যাথা সাধারণত তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তীব্র কোমর ব্যাথা হঠাৎ করে হয় এবং কয়েক সপ্তাহ বা মাসের মধ্যে সেরে যায়। দীর্ঘস্থায়ী কোমর ব্যাথা দীর্ঘদিন ধরে থাকে এবং চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। কোমর ব্যাথার চিকিৎসায় সাধারণত ওষুধ, শারীরিক থেরাপি, এবং ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়। তবে কিছু ঘরোয়া উপায়ও রয়েছে যা কোমর ব্যাথা দূর করতে সাহায্য করতে পারে।

কোমরের ব্যথা কেন হয়?

১. পেশির টান বা আঘাত

পেশির টান বা আঘাত কোমরের ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ কারণ। পেশির টান বা আঘাতের ফলে পেশিতে ব্যথা, ফোলাভাব, এবং অস্থিরতা হতে পারে। পেশির টান বা আঘাতের কারণ হতে পারে:

  • ভার উত্তোলন
  • হঠাৎ করে ঘুরে পড়া
  • দীর্ঘ সময় ধরে একই ভঙ্গিতে বসে থাকা বা দাঁড়িয়ে থাকা
  • তীব্র ব্যায়াম

২. ডিস্কের সমস্যা

মেরুদণ্ডের হাড়ের মাঝে থাকা ডিস্কগুলোতে সমস্যা হলেও কোমরের ব্যথা হতে পারে। ডিস্কগুলো নরম জেলির মতো পদার্থ দিয়ে তৈরি যা মেরুদণ্ডের হাড়গুলোকে আলাদা করে রাখে। ডিস্কের সমস্যার মধ্যে রয়েছে:

  • ডিস্কের প্রলাপস: ডিস্কের কেন্দ্রের নরম পদার্থের অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে।
  • ডিস্কের হার্নিয়া: ডিস্কের কেন্দ্রের নরম পদার্থের অংশ বাইরে বেরিয়ে আসে এবং মেরুদণ্ডের স্নায়ুকে চাপ দেয়।

৩. মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিকতা

মেরুদণ্ডের অস্বাভাবিকতা যেমন স্কোলিওসিস বা kyphosis কোমরের ব্যথার কারণ হতে পারে। স্কোলিওসিস হলো মেরুদণ্ডের বক্রতা যা সাধারণত পিঠের একপাশে দেখা যায়। Kyphosis হলো মেরুদণ্ডের সামনের দিকের বক্রতা।

৪. অভ্যন্তরীণ রোগ

কিছু অভ্যন্তরীণ রোগ যেমন অস্টিওআর্থারাইটিস বা এনকাইলোসিং স্পন্ডাইলোসিস, কোমরের ব্যথার কারণ হতে পারে। অস্টিওআর্থারাইটিস হলো হাড়ের ক্ষয়জনিত একটি রোগ যা মেরুদণ্ডের হাড়কে প্রভাবিত করতে পারে। এনকাইলোসিং স্পন্ডাইলোসিস হলো একটি প্রদাহজনিত রোগ যা মেরুদণ্ডের জয়েন্টগুলোকে প্রভাবিত করে।

৫. মানসিক চাপ

মানসিক চাপও কোমরের ব্যথার কারণ হতে পারে। মানসিক চাপের ফলে শরীরে স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয় যা পেশিকে টান টান রাখতে পারে।

 

কোমরের ব্যথার উপসর্গ

কোমরের ব্যথার উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ব্যথা
  • ফোলাভাব
  • অস্থিরতা
  • শক্ততা
  • দুর্বলতা
  • পায়ে ব্যথা বা ঝিনঝিন

 

কোমর ব্যাথা সারানোর ১০ টি সহজ উপায়

১. বিশ্রাম নিন

কোমর ব্যথার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হল বিশ্রাম। ব্যথা বেশি হলে কয়েক দিনের জন্য বিশ্রাম নিন। এতে ব্যথা কমাতে এবং মেরুদণ্ডকে আরাম দিতে সাহায্য করবে।

২. বরফ বা গরম সেঁক দিন

বরফ বা গরম সেঁক ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে। বরফ সেঁক দেওয়ার সময় বরফের টুকরো একটি কাপড়ে মুড়িয়ে কোমরের ব্যথার জায়গায় ১৫-২০ মিনিটের জন্য রাখুন। গরম সেঁক দেওয়ার সময় একটি উষ্ণ তোয়ালে বা গরম পানির বোতল কোমরের ব্যথার জায়গায় ১৫-২০ মিনিটের জন্য রাখুন।

৩. ব্যথানাশক ওষুধ খান

কোমর ব্যথা কমাতে ব্যথানাশক ওষুধ (অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, বা ন্যাপ্রোক্সেন) সাহায্য করতে পারে। তবে এই ওষুধগুলি দীর্ঘ সময় ধরে খাওয়া উচিত নয় কারণ এগুলো গ্যাস্ট্রিক আলসার এবং অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

৪. বেদনানাশক মলম বা ক্রিম ব্যবহার করুন

বেদনানাশক মলম বা ক্রিম (বেনজিল আয়োডাইড, মেথাইল স্যালিসাইলেট, বা ক্যাপ্সাইসিন) ব্যথা এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।

৫. ম্যাসাজ করুন

কোমর ব্যাথা কমাতে ম্যাসাজ করা একটি কার্যকর উপায়। এতে ব্যথার পেশীগুলি শিথিল হতে সাহায্য করে। পরিবারের কাওকে দিয়ে ম্যাসাজ করাতে পারেন বা একজন পেশাদার ম্যাসেজ থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন।

৬. সঠিকভাবে বসুন

দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার সময় সঠিকভাবে বসুন। এতে কোমর ব্যথার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। সঠিকভাবে বসতে হলে পিঠ সোজা রেখে বসুন। কোমর বাঁকা করবেন না।

৭. সঠিকভাবে ভার উত্তোলন করুন

ভার উত্তোলন করার সময় সঠিকভাবে ভার উত্তোলন করুন। ভার উত্তোলন করার জন্য প্রথমে কোমরে বাঁক দিয়ে ঝুঁকবেন না। বরং হাঁটু ভেঙে ঝুঁকুন।

৮. নিয়মিত ব্যায়াম করুন

নিয়মিত ব্যায়াম করলে কোমর ব্যথার ঝুঁকি কমে। ব্যায়াম করলে শরীরের পেশীগুলো শক্তিশালী হয়। শক্তিশালী পেশীগুলো কোমরকে ধরে রাখে এবং কোমর ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

৯. সঠিকভাবে ঘুমান

সঠিকভাবে শোওয়া কোমর ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে। শোয়ার সময় আপনার পিঠ সোজা রাখুন এবং আপনার পায়ের নিচে একটি বালিশ রাখুন।

১০. ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করুন

ধূমপান এবং মদ্যপান কোমর ব্যথার ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপান এবং মদ্যপান ত্যাগ করলে কোমর ব্যথা কমতে পারে।

 

কোমরের ব্যথা কমানোর ব্যায়াম

কোমরের ব্যথা কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ এবং চিকিৎসা রয়েছে। তবে কিছু ব্যায়ামও রয়েছে যা কোমরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

কোমরের ব্যথা কমানোর ব্যায়ামের কিছু উপকারিতা হলো:

  • কোমরের পেশীকে শক্তিশালী করে
  • কোমরের নমনীয়তা বাড়ায়
  • মেরুদণ্ডের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে
  • ব্যথার তীব্রতা কমায়
  • ব্যথার পুনরাবৃত্তি রোধে সাহায্য করে

কোমরের ব্যথা কমানোর কিছু ব্যায়াম হলো:

১. প্ল্যাঙ্ক

এই ব্যায়ামটি কোমরের পেশীকে শক্তিশালী করে এবং কোমরের নমনীয়তা বাড়ায়।

পদ্ধতি:

  • আপনার হাটু এবং হাত দিয়ে মেঝেতে ভর দিন।
  • শরীরকে একটি সরল রেখায় রাখুন।
  • কোমর সোজা রাখুন।
  • কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখুন।

২. কোল্ড স্ট্রেচ

এই ব্যায়ামটি কোমরের পেশীকে প্রসারিত করে এবং কোমরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

পদ্ধতি:

  • আপনার পা দুই কাঁধের প্রস্থে ছড়িয়ে দিন।
  • কোমর সোজা রেখে আপনার ডান পা পিছনে নিয়ে যান।
  • বাম হাত দিয়ে আপনার ডান পায়ের আঙ্গুল ধরার চেষ্টা করুন।
  • কয়েক সেকেন্ডের জন্য ধরে রাখুন।
  • একইভাবে অন্য পা দিয়েও করুন।

৩. ক্যাট-কাউ ব্যায়াম

এই ব্যায়ামটি মেরুদণ্ডের নমনীয়তা বাড়াতে সাহায্য করে।

পদ্ধতি:

  • হাত এবং পায়ের উপর ভর দিয়ে চারপাশে হাঁটু গেড়ে বসুন।
  • মাথা উপরে তুলে পিঠকে বাঁকিয়ে নিন।
  • তারপর মাথা নিচু করে পিঠকে সোজা করুন।
  • এই অবস্থানে ৫-১০ সেকেন্ড ধরে থাকুন।
  • ৫-১০ বার পুনরাবৃত্তি করুন।

৪. কাত হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় পা উপরে তোলা

এই ব্যায়ামটি কোমরের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করে।

পদ্ধতি:

  • একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন।
  • পা উপরে তুলুন।
  • এই অবস্থানে ৫-১০ সেকেন্ডের জন্য থাকুন।
  • অন্যদিকেও একইভাবে করুন।
  • ৫-১০ বার পুনরাবৃত্তি করুন।

৫. কোমরের মোচড়

এই ব্যায়ামটি কোমরের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।

পদ্ধতি:

  • মেঝেতে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ুন।
  • পাগুলো আপনার শরীরের সাথে সোজা রাখুন।
  • বাম হাত আপনার মাথার পিছনে রাখুন।
  • ডান হাত আপনার ডান হাঁটুর উপর রাখুন।
  • ডান কাঁধ এবং কোমরকে একসাথে ঘোরান।
  • বাম হাত আপনার বাম হাঁটুর দিকে নিয়ে যান।
  • কয়েক সেকেন্ড ধরে এই অবস্থানে থাকুন।
  • তারপর আস্তে আস্তে আপনার অবস্থান পরিবর্তন করুন।

 

কোমর ব্যথার খাবার

১. ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে যা কোমর ব্যথার একটি প্রধান কারণ। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে:

  • মাছ যেমন: স্যামন, ট্রাউট, এবং ম্যাকেরেল
  • বাদাম যেমন: আখরোট, চিনাবাদাম, এবং পেস্তা
  • বীজ যেমন: চিয়া বীজ এবং তিসির বীজ

২. প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

প্রোটিন পেশীর স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শক্তিশালী পেশী কোমর ব্যথা প্রতিরোধে সাহায্য করে। প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে:

  • মাছ, মাংস, ডিম
  • ডাল, শিম, বাদাম
  • দুগ্ধজাত খাবার

৩. অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার

অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবারের মধ্যে রয়েছে:

  • সবুজ শাকসবজি যেমন: পালং শাক, ব্রোকলি, এবং পাতাকপি
  • হলুদ
  • আদা
  • মশলা যেমন: দারুচিনি, গোলমরিচ, এবং রসুন

৪. প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা

পানি শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এবং এটি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। তাই কোমর ব্যথা হলে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করার চেষ্টা করুন।

 

৫. মূল জাতীয় খাবার

মূল জাতীয় খাবারগুলো শরীরকে শক্তি প্রদান করে এবং কোমর ব্যথার ব্যথা কমাতে সাহায্য করতে পারে। মূল জাতীয় খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • আলু
  • গাজর
  • বিট
  • পেঁয়াজ
  • রসুন

কোমর ব্যথার জন্য ক্ষতিকর খাবার

  • প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্রক্রিয়াজাত খাবার প্রায়ই অতিরিক্ত চিনি, লবণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। এই খাবারগুলি প্রদাহ বাড়াতে পারে এবং কোমর ব্যথার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  • ফ্রাইড ফুড: ফ্রাইড ফুড প্রদাহ বাড়াতে পারে
  • অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার: অতিরিক্ত লবণযুক্ত খাবার রক্তচাপ বাড়াতে পারে যা কোমর ব্যথার একটি কারণ।
  • অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার: অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার ওজন বাড়াতে পারে।

কোমরের ব্যথা কমানোর ট্যাবলেট

কোমরের ব্যথা কমানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের ওষুধ পাওয়া যায় যার মধ্যে রয়েছে:

  • অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ওষুধ (NSAIDs): NSAIDs হলো ব্যথানাশক ওষুধ যা প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। NSAIDs-এর মধ্যে রয়েছে ইবুপ্রোফেন, অ্যাসিটামিনোফেন, এবং ন্যাপ্রোক্সেন।
  • অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস: অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস কখনও কখনও কোমরের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস-এর মধ্যে রয়েছে অ্যামিট্রিপটাইলিন, ডুলোক্সেটিন, এবং সাইটালোপ্রাম।
  • ব্যথানাশক ট্যাবলেট: ব্যথানাশক ট্যাবলেটগুলি ব্যথা উপশম করতে সাহায্য করে। এই ট্যাবলেটগুলির মধ্যে রয়েছে: অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন, নাপ্রোক্সেন

আমাদের আজকের আলোচনা এই পর্যন্তই। এছাড়া আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্টের মাধ্যমে জানান।

ধন্যবাদ সবাইকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *