তিল একটি পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান। তিল থেকে তৈরি তিলের তেলও অত্যন্ত উপকারী। তিলের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, লোহা, সেলেনিয়াম, জিংক এবং প্রোটিন। এছাড়াও এতে রয়েছে কিছু পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন কে। আজকের আর্টিকেলে আমরা তিলের তেলের উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
Benefits using sesame oil: তিলের তেলের উপকারিতা
১. হৃদস্বাস্থ্য
তিলের তেল হৃদস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে অসম্পৃক্ত চর্বি, যা রক্তচাপ কমাতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। অসম্পৃক্ত চর্বি এর মধ্যে রয়েছে ওমেগা-৬ এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিড রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও তিলের তেলে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গ্রহণকারীদের মধ্যে হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কম ছিল।
২. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
তিলের তেল রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এতে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম যা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। ম্যাগনেসিয়াম একটি খনিজ যা রক্তনালীগুলোকে শিথিল করতে সাহায্য করে। এতে করে রক্তচাপ কমে যায়।
৩. ক্যান্সার প্রতিরোধ
তিলের রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। এছাড়া তিলের তেলে রয়েছে সেসামোল যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেসামোল ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার রোধ করতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গ্রহণকারীদের মধ্যে কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক কম ছিল।
৪. কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণ
তিলের তেলে রয়েছে ফাইবার যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়া তিলের তেল পাচনতন্ত্রকে স্বাস্থ্যকর রাখতেও সাহায্য করে।
৬. ত্বকের স্বাস্থ্য
তিলের তেল ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে ভিটামিন ই যা ত্বকের কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ই একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ত্বকের বয়সের ছাপ দূর করতে সাহায্য করে। এটি ত্বককে মসৃণ এবং উজ্জ্বল করে তোলে। নিয়মিত ত্বকে তিলের তেল ব্যবহার করলে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
৭. হজমশক্তি বৃদ্ধি
তিলের তেলে রয়েছে ফাইবার যা হজমশক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। তিলের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। ফাইবার খাদ্যের সাথে মিশে একটি জেল তৈরি করে। এই জেল পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে খাদ্যকে মসৃণভাবে চলাচল করতে সাহায্য করে। এতে করে খাদ্য হজম হতে সহজ হয়। এছাড়াও তিলের তেলে রয়েছে সেসামোল যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেসামোল পাচনতন্ত্রের স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়াগুলিকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এতে করে হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
৮. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
তিলের তেলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া তিলের তেলে রয়েছে সেসামোল যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেসামোল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গ্রহণকারীদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি কম ছিল।
৯. ব্রেন হেলথ
তিলের তেল ব্রেন হেলথের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে সেসামোল। সেসামোল ব্রেন কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গ্রহণকারীদের মধ্যে ব্রেন ডিমেনশিয়া এবং আলঝাইমার রোগের ঝুঁকি কম ছিল।
১০. ওজন কমানো
তিলের তেলে রয়েছে ফাইবার যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। তিলের তেলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। ফাইবার ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গ্রহণকারীদের মধ্যে ওজন কমানো সহজ ছিল।
তিলের তেলের অপকারিতা
১. অ্যালার্জি
তিলের তেলের সবচেয়ে সাধারণ অপকারিতা হল অ্যালার্জি। তিলের প্রতি কারও যদি অ্যালার্জি থাকে তাহলে তিলের তেল খেলে বা ত্বকে ব্যবহার করলে অ্যালার্জির লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অ্যালার্জির লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে চুলকানি, ফুসকুড়ি, শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব এবং বমি।
২. অতিরিক্ত গ্রহণ
তিলের তেল একটি সুষম খাদ্যের অংশ হতে পারে। তবে অতিরিক্ত তিলের তেল গ্রহণের ফলে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত তিলের তেল গ্রহণের ফলে ওজন বৃদ্ধি, কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩. উচ্চ তাপমাত্রায় ব্যবহার
তিলের তেল একটি স্থিতিশীল তেল। তবে উচ্চ তাপমাত্রায় তিলের তেল ব্যবহার করলে এটি বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করতে পারে। তাই, তিলের তেল দিয়ে ভাজা, ভেজে বা সিদ্ধ করা খাবার খাওয়ার সময় সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
৪. রক্তপাতের সমস্যা
তিলের তেলে অ্যান্টি-ক্যান্সার উপাদান রয়েছে। তবে এই উপাদানগুলি রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই যারা রক্তপাতের সমস্যায় ভুগছেন তাদের তিলের তেল খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
৫. গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্য
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের জন্য তিলের তেল নিরাপদ কিনা তা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। তবে কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে তিলের তেল গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভাবস্থার জটিলতা এবং স্তন্যদানকারী মহিলাদের দুধের উৎপাদন কমাতে পারে। তাই গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের তিলের তেল খাওয়ার আগে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
চুলের জন্য তিলের তেলের উপকারিতা
তিলের তেল একটি প্রাকৃতিক তেল যা চুলের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি উপাদান, যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। তিলের তেল চুলের বৃদ্ধি, চুল পড়া রোধ, খুশকি দূর করা, চুলের গোড়া শক্ত করা, চুলের রুক্ষতা দূর করা এবং চুলকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করে তোলার জন্য সাহায্য করে।
চুলের জন্য তিলের তেলের উপকারিতাগুলো নিম্নরূপ:
- চুলের বৃদ্ধি: তিলের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যা চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। নিয়মিত মাথার ত্বকে তিলের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে চুলের গোড়া শক্ত হয় এবং চুলের বৃদ্ধি ভালো হয়।
- চুল পড়া রোধ: তিলের তেলে রয়েছে সেসামোল, যা একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেসামোল চুলের গোড়ায় রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে এবং চুল পড়া রোধ করে।
- খুশকি দূর করা: তিলের তেলে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যা খুশকি দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত মাথার ত্বকে তিলের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে খুশকি দূর হয় এবং মাথার ত্বক সুস্থ থাকে।
- চুলের গোড়া শক্ত করা: তিলের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই যা চুলের গোড়াকে শক্ত করে। নিয়মিত মাথার ত্বকে তিলের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে চুলের গোড়া শক্ত হয় এবং চুল পড়া কমে।
- চুলের রুক্ষতা দূর করা: তিলের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা চুলের রুক্ষতা দূর করে। নিয়মিত মাথার ত্বকে তিলের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে চুল মসৃণ ও উজ্জ্বল হয়।
- চুলকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করা: তিলের তেলে রয়েছে ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা চুলকে সুন্দর ও উজ্জ্বল করে। নিয়মিত মাথার ত্বকে তিলের তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে চুলের রঙ গাঢ় হয় এবং চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।
ত্বকের যত্নে তিলের তেল
তিলের তেল প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত একটি তেল যা ত্বকের যত্নে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে রয়েছে ভিটামিন ই, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
ত্বকের যত্নে তিলের তেলের উপকারিতা নিম্নরুপ:
- ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করে
- ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখে
- ত্বককে নরম ও কোমল করে
- ত্বকের রুক্ষতা দূর করে
- ত্বকের বলিরেখা ও বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে
- ব্রণ ও ব্রণের দাগ দূর করে
- খুশকি দূর করে
ত্বকের ক্ষেত্রে তিলের তেল ব্যবহারের কিছু প্রণালি
- ব্রণের জন্য: তিলের তেল ও হলুদের গুঁড়া মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট ব্রণ আক্রান্ত স্থানে লাগান। ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- রোদে পোড়া দাগের জন্য: তিলের তেল ও অ্যালোভেরা জেল মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট রোদে পোড়া দাগের স্থানে লাগান। ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- বলিরেখা দূর করার জন্য: তিলের তেল ও মধু মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন। এই পেস্ট মুখে লাগান। ১৫-২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
তিলের তেল খাওয়ার নিয়ম
তিলের তেল একটি পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য উপাদান। এটি খাওয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। তিলের তেল খাওয়ার নিয়ম নিম্নরূপ:
- তিলের তেল খাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হল খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে তিলের তেল যোগ করা। যেকোনো ধরনের রান্নায় তিলের তেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
- তিলের তেল দিয়ে সালাদ তৈরি করে খাওয়া যেতে পারে।
- তিলের তেল দিয়ে পাস্তা, নুডলস বা অন্যান্য খাবার রান্না করা যেতে পারে।
- তিলের তেল দিয়ে মাছ বা মাংস রান্না করা যেতে পারে।
- তিলের তেল দিয়ে নাস্তা বা জলখাবার তৈরি করা যেতে পারে।
তিলের তেল খাওয়ার পরিমাণ:
- প্রতিদিনের খাবারের সাথে অল্প পরিমাণে তিলের তেল খাওয়া উচিত।
- একবারে ১-২ চা চামচ তিলের তেল খাওয়া যেতে পারে।
তিলের তেলের দাম কত
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের তিলের তেলের দাম প্রতি লিটার ২০০ থেকে ২৫০ টাকার মধ্যে। দেশী তিলের তেলের দাম প্রতি লিটার ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা আর আমদানিকৃত তিলের তেলের দাম প্রতি লিটার ২০০ টাকার বেশী। দোকান ভেদে দাম ভিন্ন হতে পারে।
FAQ
প্রতিদিন কতটুকু তিলের তেল খাওয়া উচিত?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন ২-৩ চা চামচ তিলের তেল খাওয়া উচিত। এতে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলো পূরণ হয়।
তিলের তেল খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা উচিত। যেমন:
- তিলের তেল গরম করে খাওয়া উচিত নয়।
- তিলের তেল বেশি পরিমাণে খাওয়া উচিত নয়।
তিলের তেল খেলে কি পেট খারাপ হয়?
তিলের তেল খেলে পেট খারাপ হতে পারে তবে তা খুবই কম দেখা যায়। তিলের তেলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে যা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত পরিমাণে তিলের তেল খেলে তা পেট খারাপের কারণ হতে পারে। কারণ ফাইবার বেশি পরিমাণে খেলে পেটে গ্যাস তৈরি হতে পারে যা পেট ফাঁপা, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া তিলের তেল খেলে কারও কারও অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে পেট খারাপের পাশাপাশি, ত্বকে চুলকানি, ফোলাভাব, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। তিলের তেল খেয়ে যদি পেট খারাপ হয় তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রচুর পরিমাণে পানি পান করা উচিত। এছাড়াও অ্যাসিডিটি কমাতে লেবুর রস বা ভিনেগার পান করা যেতে পারে। যদি পেট খারাপের সমস্যা বেশি হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আশাকরি আপনারা তিলের তেলের উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। এছাড়া আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে তাহলে কমেন্ট করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।