চুলের আগা ফেটে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। বাইরের পরিবেশের প্রভাব, পুষ্টির অভাব, অনিয়মিত চুলের যত্ন, ইত্যাদি কারণে চুলের আগা ফেটে যেতে পারে। চুলের আগা ফেটে গেলে চুলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও চুলের আগা ফেটে গেলে চুল রুক্ষ ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। চুলের আগা ফেটে যাওয়া রোধ করার জন্য এবং চুলের আগা ফেটে গেলে সেগুলো মেরামত করার জন্য কিছু করণীয় রয়েছে। আজকের পোস্টে আমরা সেইসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
make it merge
চুলের আগা ফাটার কারন
চুলের আগা ফাটার প্রধান কারণ হলো চুলের যত্নের অভাব। তবে এর পাশাপাশি কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক ও পরিবেশগত কারণেও চুলের আগা ফেটে যেতে পারে।
- ভিটামিন ও মিনারেলসের অভাব: চুলের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও মিনারেলের মধ্যে রয়েছে ভিটামিন এ, বি, সি, ই, জিংক, আয়রন, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। এসব ভিটামিন ও মিনারেলের অভাবে চুলের আগা ফাটা, চুল পড়া, চুল শুষ্ক ও নিষ্প্রাণ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- হরমোনের তারতম্য: হরমোনের তারতম্যও চুলের আগা ফাটার একটি কারণ হতে পারে। বয়ঃসন্ধি, গর্ভাবস্থা, ঋতুস্রাব, মেনোপজ ইত্যাদি সময় হরমোনের তারতম্য দেখা দেয় যার ফলে চুলের আগা ফেটে যেতে পারে।
- থাইরয়েড সমস্যা: থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাও চুলের আগা ফাটার কারণ হতে পারে। থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কম বা বেশি হলে চুলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং চুলের আগা ফেটে যেতে পারে।
- দীর্ঘস্থায়ী রোগ: ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, লিভার রোগ ইত্যাদি দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণেও চুলের আগা ফেটে যেতে পারে।
- দূষণ: বাতাসের দূষণ চুলের আগা ফাটার একটি অন্যতম কারণ। বাতাসে থাকা ক্ষতিকর পদার্থ চুলের কিউটিকলকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে চুলের আগা ফেটে যেতে পারে।
- রোদ: রোদের অতিবেগুনী রশ্মি চুলের আগা ফাটাতে ভূমিকা রাখে।
- রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার: চুলের স্টাইলিংয়ের জন্য হেয়ার ড্রায়ার, হেয়ার স্টাইলিং জেল, স্প্রে, রঙ, রিবন্ডিং, কার্লিং ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার চুলের আগা ফাটাতে পারে।
চুলের আগা ফেটে গেলে করণীয়
১. নিয়মিত চুলে তেল মালিশ করুন
চুলের আগা ফেটে যাওয়া রোধে নিয়মিত চুলে তেল মালিশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তেল চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং চুলের গোড়া শক্ত করে। নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, আমন্ড অয়েল, ক্যাস্টর অয়েল ইত্যাদি তেল চুলের জন্য উপকারী।
২. নিয়মিত চুল ট্রিম করুন
চুলের আগা ফেটে গেলে দ্রুত ট্রিম করা উচিত। ফাটা অংশ কেটে ফেললে বাকি অংশের চুলের ক্ষতি রোধ করা সম্ভব হয়।
৩. সঠিক শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন
আপনার চুলের ধরন অনুযায়ী সঠিক শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। শ্যাম্পু এবং কন্ডিশনার চুলের আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং চুলকে মজবুত করতে সাহায্য করে।
৪. চুল অতিরিক্ত টানবেন না
চুল অতিরিক্ত টানলে চুলের আগা ফেটে যেতে পারে। তাই চুল আঁচড়ানোর সময় বা হেয়ার স্টাইল করার সময় চুলকে টানবেন না।
৫. চুলকে সূর্যের ক্ষতি থেকে রক্ষা করুন
সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি চুলের ক্ষতি করতে পারে। তাই রোদে বের হওয়ার আগে চুলে সানস্ক্রিন বা ক্যাপ ব্যবহার করুন।
৬. ধূমপান এবং অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকুন
ধূমপান এবং অ্যালকোহল পান চুলের ক্ষতি করতে পারে। তাই চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ধূমপান এবং অ্যালকোহল পান থেকে বিরত থাকুন।
৭. পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খান
চুলের স্বাস্থ্যের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চুলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান হলো প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ।
৮. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ফলে চুলের গোড়ায় রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি পায় এবং চুলের বৃদ্ধি ভালো হয়।
৯. মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করুন
মানসিক চাপ চুলের ক্ষতি করতে পারে। তাই মানসিক চাপ কমাতে চেষ্টা করুন।
১০. চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন
যদি উপরের উপায়গুলো অনুসরণ করেও চুলের আগা ফেটে যাওয়ার সমস্যা না কমে তাহলে চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চুলের আগা ফাটা রোধ করার ঘরোয়া উপায়
১. নিয়মিত তেল মালিশ করা
নারকেল তেল, অলিভ অয়েল, আমন্ড অয়েল, বা যেকোনো প্রাকৃতিক তেল চুলের আগা ফাটা রোধে কার্যকর। সপ্তাহে অন্তত ২-৩ দিন তেল মালিশ করলে চুলের গোড়া শক্ত হয় এবং নতুন চুল গজাতে সাহায্য করে।
তেল মালিশ করার পদ্ধতি:
- চুল ভালো করে ধুয়ে নিন।
- তেল হালকা গরম করে নিন।
- মাথার ত্বকে এবং চুলে তেল ভালো করে ম্যাসাজ করুন।
- তেল মাথায় ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
২. ডিম
ডিমে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ডিম হেয়ার মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করলে চুলের আগা ফাটা রোধে সাহায্য করে।
ডিমের হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১টি ডিম নিন।
- ১ চা চামচ মধু যোগ করুন।
- ১ চা চামচ অলিভ অয়েল যোগ করুন।
- মিশ্রণটি ভালো করে মিশিয়ে নিন।
- মাথার ত্বকে এবং চুলে মিশ্রণটি লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৩. মেথি
মেথিতে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
মেথি হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১ টেবিল চামচ মেথি নিন।
- মেথি পানিতে ভিজিয়ে রাখুন।
- মেথি নরম হয়ে গেলে, পানি ঝরিয়ে নিন।
- মেথি ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে পেস্ট তৈরি করুন।
- পেস্টটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৪. আমলকী
আমলকীতে রয়েছে ভিটামিন সি, ই, এবং কে যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
আমলকী হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১ টেবিল চামচ আমলকী পাউডার নিন।
- ১ টেবিল চামচ নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন।
- মিশ্রণটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৫. লেবু
লেবুতে রয়েছে ভিটামিন সি যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
লেবুর রস হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- একটি লেবু কেটে রস বের করে নিন।
- রসটি একটি পরিষ্কার কাপড়ে ছেঁকে নিন।
- রসটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৬. রসুন
রসুনে রয়েছে অ্যালিসিন যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অ্যালিসিন একটি অ্যান্টি-ফাংগাল এবং অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান যা চুলের গোড়ায় সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রসুন হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ৫-৬ কোয়া রসুন কুচি করে নিন।
- রসুন কুচি ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে পেস্ট তৈরি করুন।
- পেস্টটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৭. নারকেলের দুধ
নারকেলের দুধে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
নারকেলের দুধ হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১/২ কাপ নারকেলের দুধ নিন।
- নারকেলের দুধ মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৮. অ্যালোভেরা
অ্যালোভেরাতে রয়েছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
অ্যালোভেরা হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- একটি অ্যালোভেরা পাতা থেকে জেল বের করে নিন।
- জেলটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৯. কলা
কলায় রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
কলা হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১টি কলা নিন।
- কলা চটকে নিন।
- কলা মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
১০. আমন্ড
আমন্ডে রয়েছে প্রোটিন, ভিটামিন, এবং খনিজ যা চুলের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
আমন্ড হেয়ার মাস্ক তৈরির উপায়:
- ১/২ কাপ আমন্ড বাটা নিন।
- ১/৪ কাপ নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল মিশিয়ে নিন।
- মিশ্রণটি মাথার ত্বকে এবং চুলে লাগান।
- ৩০-৬০ মিনিট রেখে দিন।
- তারপর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
চুলের আগা কাটার নিয়ম
প্রয়োজনীয় উপকরণ:
- চুল কাটার সরঞ্জাম (কাঁচি, চিরুনি, ব্রাশ)
- ট্রে বা বাটি
- শেভিং ক্রিম বা জেল
- তোয়ালে
প্রণালী:
- চুল ভালো করে ধুয়ে নিন এবং শুকিয়ে নিন।
- চুলের আগা ফাটা আছে কিনা ভালো করে পরীক্ষা করে নিন।
- ট্রে বা বাটিতে শেভিং ক্রিম বা জেল লাগিয়ে নিন।
- চুলের আগা শেভিং ক্রিম বা জেলে ভিজিয়ে নিন।
- চুলের আগা সাবধানে কাটুন।
চুলের আগা কতটা কাটবেন
চুলের আগা কতটা কাটবেন তা নির্ভর করে চুলের ধরন এবং কাটতে চাওয়া ডিজাইনের উপর। সাধারণত, চুলের আগা ১/২ ইঞ্চি বা ১.২৫ সেমি কাটা হয়। তবে চুল যদি খুব শুষ্ক এবং রুক্ষ হয় তাহলে আগা আরও বেশি কাটা যেতে পারে।
চুলের আগা কতদিন পর কাটবেন
চুলের আগা কতদিন পর কাটবেন তা নির্ভর করে চুলের ধরন এবং চুলের আগা ফাটার হারের উপর। সাধারণত চুলের আগা ৪-৬ সপ্তাহ পর কাটা হয়। তবে চুল যদি খুব দ্রুত ফাটে তাহলে আগা আরও বেশি দিন পর কাটা যেতে পারে।
আমাদের আজকের আলোচনা এই পর্যন্তই। এছাড়া আপনার কোনো প্রশ্ন থাকলে আমাদের কমেন্ট করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।