স্বামীর সাহায্য ছাড়াই সুষ্ঠুভাবে সংসার চালানো, ছেলেমেয়ে মানুষ করা এবং নিজের শর্তে জীবনযাপন করে থাকেন একজন সিঙ্গল পেরেন্ট। সাহস এবং আত্মবিশ্বাস তাঁদের নিত্যসঙ্গী। এই ওয়ান ম্যান আর্মি নিয়ে একটি আলোচনা।
সিঙ্গল পেরেন্টিং কিভাবে আপনার সন্তানকে সঠিক ভাবে লালন পালন করবেন ! আর হয়ে উঠুন একাই ১০০
অনেক চেষ্টা করছিল রূপসা। ক্রমাগত ৮ বছর ধরে। কিন্তু কোনওভাবেই টিকিয়ে রাখতে পারল না তার বিয়েটা। ঘুমভাঙা শীতের সকালে ৬ বছরের মনসিজকে নিয়ে দীপায়নের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একটাই কথা সে ভেবে চলেছিল বারংবার যে, তার ভুলটা ঠিক কোথায়। ফুলশয্যার রাতেই রূপসা জানতে পারে যে, তার স্বামী, দীপায়ন মাদকাসক্ত। কলেজবেলা থেকেই গাঁজা, হেরোইন, চরস ইত্যাদি খাওয়ায় সে সিদ্ধহস্ত। চিকিৎসা, কাউন্সেলিং, রিহ্যাবিলিটেশন কোনও কিছুই দীপায়নকে সর্বনাশা নেশার কবল থেকে মুক্ত করতে পারল না। যখন রূপসাকে মারধর করে টাকাপয়সা কেড়ে নেওয়া শুরু করল দীপায়ন, তখনই ও বুঝতে পারল যে দীপায়নকে ছাড়াই এবর একে এগিয়ে যেতে হবে।
নবনিতাও একা। স্বামী রাজর্ষিকে নিয়ে সংসার করতে পেরেছিল ৬ বছর। তারপর ৭ দিনের জ্বরে মারা গেল, রাজর্ষি। ৪ বছরের টিয়া আর ১ বছরের টুকাইকে নিন, জীবনটাকে নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করছে নরমিতা। খড়কুটোর মতো রাজর্ষির রেখে যাওয়া ব্যবসাটা আঁকড়ে রূপসা আর নবমিতার সমস্যার ভিন্নতা থাকলেও, এক জায়গায় ওরা দুজনেই এক। রূপসা এবং নরমিতা দুজনেই, সিঙ্গল মাদার, যাঁরা স্বামীর সাপোর্ট ছাড়াই সন্তানদের বড় করে তুলছেন। প্রথমেই বলে রাখা ভাল, কাজটা খুব একটা সহজ নয়। বাবা, মা দুজনের সাহচর্যই সন্তানের প্রয়োজন। কিন্তু দুজনের সেই কাজটাই অনেক সিঙ্গল মাদার একাই করে চলেছেন সাহসে বুক বেঁধে।
সন্তানের সঙ্গে
- ওয়ার্কিং মাদাররা চেষ্টা করুন অফিসের টেনশন বাড়িতে বয়ে না আনার। বাড়িতে থাকার সময়টুকু ওদের সঙ্গে গল্প করে, খেলা করে, হোমওয়র্কে সাহায্য করে কাটান। খেয়াল রাখুন বাবা সঙ্গে না থাকার কারণে ওরা যাতে কোনওরকম ইনসিকিওরিটিতে না ভোগে।
- সন্তানের কাছে নিজের অবস্থানটা সব সময় পরিষ্কার রাখুন। যদি আপনার ডিভোর্স হয়ে থাকে, বাবার দোষটাকে কখনওই বড় করে দেখিয়ে দোষারোপ করার চেষ্টা করবেন না। কে ঠিক বা কে ভুল সেটা ওদেরই বুঝে নিতে দিন।
- সাধ্যের অতিরিক্ত খরচ পারতপক্ষে করবেন না। স্ট্রিই হওয়ার কারণটা বাচ্চাদের বুঝিয়ে বলুন এ থেকেও সাহায্য চান। দেখবেন ওরা বায়না করা কমিয়ে দেবে।
- কোনওভাবেই বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের বাবার সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করবেন না। বাবা যদি মারা গিয়ে থাকেন, তা হলে তার কথা, গল্প ওদের শোনাবেন যাতে ওরা ওঁকে চিনতে শেখে। যদি আপনি ডিভোর্সি হন, তা হলেও নিয়মিত বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলা, দেখা করা, ছুটি কাটানো থেকে ওদের বঞ্চিত করবেন না। আইনি লড়াই থেকেও যতটা সম্ভব বাচ্চাদের দূরে রাখুন।
- বাচ্চাদের ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী করে তুলুন। নিজের জামাজুতো, বইপত্র ঠিকঠাক রাখা, সহজসরল রান্না করা, দরকার পড়লে ইমার্জেন্সি হ্যান্ডল করা—এইগুলো ছেলেবেলা থেকেই শেখান। বড় দাদা বা দিদিকে ছোট ভাই বা বোনের ন্যাপি পালটানো, দুধ গরম করা, জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা ইত্যাদি শিখিয়ে দিন।
- নিজের চারদিকে একটা সুরক্ষিত সামাজিক বলয় গড়ে তুলুন। বাবা, মা, আত্মীয়স্বজন, অফিসের কোলিগ, প্রতিবেশী, বাচ্চাদের স্কুলের টিচার, বাড়ির কাজের লোকের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন এবং সর্বদা যোগাযোগ রক্ষা করে চলুন।
- সিঙ্গল মাদাররা অনেক সময় নিজেরাই সন্তানদের ব্যাপারে ইনসিকিওরিটিতে ভোগেন। সন্তানদের আঁকড়ে রাখা এর অন্যতম লক্ষণ। সন্তানের প্রতি টান এবং ভালবাসা অবশ্যই থাকবে কিন্তু সেটা যেন কখনওই পজেসিভনেসে না পরিণত হয়।
হোম ম্যানেজমেন্ট
- যে কোনও একটা পেশা নিজের জন্য বেছে নিন। কারণ আংশিকভাবে হলেও সন্তানদের এবং নিজের খরচ আপনাকেই সামলাতে হবে। শুধুমাত্র স্বামীর রেখে যাওয়া টাকাপয়সা বা অ্যালিমনির উপর নির্ভর করা কাজের কথা নয়।
- ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্ট, ফিক্সড ডিপোজিট, ইনশিয়োরেন্সে থাকা টাকাপয়সার হিসেব ভাল করে বুঝে নিন। সেভিংস এবং ইনভেস্টমেন্ট সংক্রান্ত কাগজপত্র আলাদা আলাদা ফাইলবন্দি করুন। প্রতি কিস্তিতে কত প্রিমিয়াম দিতে হবে বা কত ডিভিডেন্ড পাবেন তার হিসেব অবশ্যই রাখবেন। ছেলেমেয়ে একটু বড় হলে তাদের নামেও ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে দিন যাতে তারা ছোট থেকেই মানি ম্যানেজমেন্ট শিখতে পারে।
- প্রথম থেকেই বাজেট করে চলতে শিখুন। মাসের বিভিন্ন খরচ যেমন ইলেকট্রিক বিল, স্কুলের ফিল্ম, মাসকাবারি বাজার আলাদা আলাদা নামে ঢুকিয়ে রাখুন যাতে হিসেবে গোলমাল না দেখা দেয়।
- ছেলেমেয়ে টিন এসে পৌঁছলে তাদের পার্ট টাইম জব করতে এনকারেজ করুন। পড়ানো, এন জি ও-র হয়ে কাজ করা বা রিটেল শপে টেনি হিসেবে কাজ করে এক্সপেরিয়েন্সও বাড়বে, পকেট মানিরও একটা সুরাহা হলে।
স্মার্ট পেরেন্টিং
- সপ্তাহে একটা সঙ্গে নিজের জন্যে রাখুন। কোনও বিশ্বাসভাজন বেবি সিটার বা কাজের লোকের দাবিতে বাচ্চাদের রেখে বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, নিজস্ব শপিং বা পার্লারে যাওয়ার মতো কাজগুলো সেরে নিন।
>> বছর দশেক আগে আরন্যের জেরে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তারপর থেকেই আমি একাই আমার ছেলেকে মানুষ করে তুলেছি। ও পরের বছর মাধ্যমিক দেবে। ইদানীং ওকে ওর স্কুলের বন্ধুরা, টিচাররা বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে নানা তির্যক মন্তব্য করে। আমি যেহেতু ওকে কিছুই খুলে বলিনি, এ কোনও উত্তর দিতে পারে না। আমার প্রতি ক্ষোভ জমছে বুঝতে পারি। কিন্তু আমি কি করব বুজতে পারছি না । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, মালিবাগ
>> আপনার ছেলে এখন টিন এজার। এই বয়েসটা খুবই সেনসিটিভ। বাবার স ওকে বাধিত এবং কনফিউসড – দুইই করছে। যেহেতু আপনার কাছ থেকেও সদুত্তর পাচ্ছে না, আপনার উপর রাগ হওয়া স্বাভাবিক। আপনার উচিত হবে ওকে আপনার এবং আপনার স্বামীর মনোমালিনার ব্যাপারটা যতটা সম্ভব সহ্য করে ওকে বুঝিয়ে বলা। চেষ্টা করুনা ওর বাবা সম্বন্ধে কোনও নেগেটিভ মন্তব্য না করাতে। তবে একে এটা বুঝিয়ে দিন যে, আপনি ওর ভাল চান এবং সব সময় ওকে সাপোর্ট দেবেন। স্কুলে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে ছেলের অসুবিধার কথা নিয়ে আলোচনা করে স্যার একটা সুরাহা করতে পারেন।
- একা সংসার চালাতে হচ্ছে বলে হবি বা শখগুলো শিকেয় তুলে দেবেন না। ছুটির দিনে বা বাচ্চারা বাড়ির বাইরে থাকলে নিজেরা শখের চর্চা করুন। চেষ্টা করুন বাচ্চাদের মধ্যে আপনার শখের প্রতি উৎসাহ জাগাতে।
- বছরে একবার বেড়াতে যান। কাছাকাছির মধ্যে হলেও বাচ্চাদের নিয়ে দু-তিনদিনের জন্যে হইহই করে আসুন। যদি অন্য কোনও পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যান, তা হলে ক শেয়ারিংও হবে, অন্যান্য সমস্যাও কমে যাবে।
- একা লাগলে বন্ধুদের ফোন করে খানিকক্ষণ গল্প করুন বা ভাষারও লিখতে পারেন। অযথা ব্লুড করে বা হীনম্মন্যতায় ভুগলে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।
- বাচ্চার স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন স্পোর্টস, অ্যানুয়াল ডে, পেরেন্টস ডে অবশ্যই অংশগ্রহণ করুন।