মুসুর ডাল একটি পুষ্টিকর খাবার হিসেবে আমাদের সকলেরই পরিচিত। তবে এই ডাল শুধু খাবারের জন্যই উপকারী নয় ত্বকের যত্নেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকাল থেকেই ত্বকের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে মুসুর ডালের ব্যবহার হয়ে আসছে। মুসুর ডালে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদান। এটি ত্বকের মৃত কোষ দূর করে, ত্বককে আর্দ্র রাখে, ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা যেমন- ট্যান, ব্রণ, বলিরেখা ইত্যাদি দূর করতে সাহায্য করে।
মসুর ডালের উপকারিতা
মসুর ডালের স্বাস্থ্য উপকারিতা সমূহ:
- প্রোটিন সরবরাহ করে: মসুর ডাল প্রোটিনের একটি ভালো উৎস। এতে প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ২৬ গ্রাম প্রোটিন থাকে। প্রোটিন শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি শরীরের বৃদ্ধি, ক্ষয়পূরণ এবং সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয়।
- হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: মসুর ডালে থাকা ফাইবার রক্তের কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে। ফলে হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপের মতো রোগের ঝুঁকি কমে।
- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: মসুর ডালে থাকা ফাইবার রক্তের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা পটাসিয়াম ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- ওজন কমাতে সাহায্য করে: মসুর ডালে থাকা ফাইবার ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে। এতে থাকা প্রোটিন পেশী গঠনে সাহায্য করে।
- হজমে সাহায্য করে: মসুর ডালে থাকা ফাইবার হজমে সাহায্য করে। এতে থাকা পটাসিয়াম কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
- ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: মসুর ডালে থাকা ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের ক্ষতি থেকে রক্ষা করে।
- চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: মসুর ডালে থাকা প্রোটিন এবং আয়রন চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। এতে থাকা ভিটামিন এ চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- অন্যান্য উপকারিতা: মসুর ডালে থাকা ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এতে থাকা ক্যালসিয়াম হাড় এবং দাঁতের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
মসুর ডাল দিয়ে ফর্সা হওয়ার উপায়
মসুর ডাল দিয়ে ফর্সা হওয়ার জন্য বিভিন্ন উপায়ে ফেসপ্যাক তৈরি করা যায়। এই ফেসপ্যাকগুলো ব্যবহার করলে ত্বকের ট্যান দূর হয়, ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ হয়।
শুষ্ক ত্বকের জন্য মসুর ডালের ফেসপ্যাক
শুষ্ক ত্বকের জন্য মসুর ডাল, দুধ এবং আমন্ড অয়েল দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করা যায়। এই ফেসপ্যাকটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
উপকরণ:
- ৫০ গ্রাম মসুর ডাল
- ১ চা চামচ দুধ
- ১ চা চামচ আমন্ড অয়েল
প্রণালী:
- মসুর ডাল ভালো করে ধুয়ে নিন।
- এরপর এটি সারারাত ভিজিয়ে রাখুন।
- সকালে ভিজিয়ে রাখা মসুর ডাল বেটে নিন।
- এরপর এর মধ্যে দুধ এবং আমন্ড অয়েল মিশিয়ে নিন।
- মিশ্রণটি মুখের সমস্ত অংশে লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
সেনসিটিভ ত্বকের জন্য মসুর ডালের ফেসপ্যাক
সেনসিটিভ ত্বকের জন্য মসুর ডাল, আমন্ড অয়েল, গ্লিসারিন এবং গোলাপজল দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করা যায়। এই ফেসপ্যাকটি ত্বকের জ্বালাভাব দূর করে।
উপকরণ:
- ১ টেবিল চামচ মসুর ডাল
- ১ টেবিল চামচ আমন্ড অয়েল
- ১ টেবিল চামচ গ্লিসারিন
- কয়েক ফোঁটা গোলাপজল
প্রণালী:
- মসুর ডাল ভালো করে ধুয়ে নিন।
- এরপর এটি বেটে নিন।
- এরপর এর মধ্যে আমন্ড অয়েল, গ্লিসারিন এবং গোলাপজল মিশিয়ে নিন।
- মিশ্রণটি মুখের সমস্ত অংশে লাগান।
- ১০ মিনিট পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
সাধারণ ও তৈলাক্ত ত্বকের জন্য মসুর ডালের ফেসপ্যাক
সাধারণ ও তৈলাক্ত ত্বকের জন্য মসুর ডাল, দুধ, হলুদ এবং নারকেল তেল দিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করা যায়। এই ফেসপ্যাকটি ত্বকের ব্রণ ও তেলতেলেভাব দূর করে।
উপকরণ:
- ১ টেবিল চামচ মসুর ডাল
- ২ টেবিল চামচ দুধ
- ১ চিমটি হলুদ
- কয়েক ফোঁটা নারকেল তেল
প্রণালী:
- মসুর ডাল ভালো করে ধুয়ে নিন।
- এরপর এটি বেটে নিন।
- এরপর এর মধ্যে দুধ, হলুদ এবং নারকেল তেল মিশিয়ে নিন।
- মিশ্রণটি মুখের সমস্ত অংশে লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট পর ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
সপ্তাহে ২-৩ বার এই ফেসপ্যাকগুলো ব্যবহার করলে ত্বক ফর্সা ও মসৃণ হবে।
ব্রণের দাগ দূর করতে মসুর ডাল
ব্রণ একটি সাধারণ ত্বকের সমস্যা যা যেকোনো বয়সের মানুষকেই আক্রান্ত করতে পারে। ব্রণ হলে ত্বকের উপর লালচে দাগ, ফুসকুড়ি, ব্যথা ইত্যাদি দেখা যায়। ব্রণ ভালো হয়ে গেলেও তার দাগ থেকে যায়। এই দাগ দূর করার জন্য অনেকেই নানা রকম প্রসাধনী ব্যবহার করেন। কিন্তু অনেক সময় এসব প্রসাধনী ত্বকের ক্ষতি করে। মসুর ডাল একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা ব্রণের দাগ দূর করতে সাহায্য করে। মসুর ডালে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ এবং ভিটামিন যা ত্বককে পরিষ্কার করে, ব্রণের দাগ দূর করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল করে। ব্রণের দাগ করতে নিম্নোক্ত উপায় গুলো অনুসরণ করুন।
মসুর ডাল গুঁড়া
ব্যবহারবিধি:
- মুখ ভালো করে ধুয়ে নিন।
- একটি পাত্রে মসুর ডালের গুঁড়া নিন।
- এর সাথে পরিমাণমতো দুধ বা গোলাপ জল মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।
- এই পেস্ট ব্রণের দাগের উপর লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট পর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এই পদ্ধতিটি সপ্তাহে ২-৩ দিন ব্যবহার করুন। নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ দূর হয়ে যাবে।
মসুর ডাল এবং মধু
মসুর ডাল এবং মধুর মিশ্রণও ব্রণের দাগ দূর করতে কার্যকর।
ব্যবহারবিধি:
- মুখ ভালো করে ধুয়ে নিন।
- একটি পাত্রে মসুর ডালের গুঁড়া নিন।
- এর সাথে পরিমাণমতো মধু মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।
- এই পেস্ট ব্রণের দাগের উপর লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট পর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
মসুর ডাল এবং লেবুর রস
মসুর ডাল এবং লেবুর রসের মিশ্রণও ব্রণের দাগ দূর করতে কার্যকর।
ব্যবহারবিধি:
- মুখ ভালো করে ধুয়ে নিন।
- একটি পাত্রে মসুর ডালের গুঁড়া নিন।
- এর সাথে পরিমাণমতো লেবুর রস মিশিয়ে একটি পেস্ট তৈরি করুন।
- এই পেস্ট ব্রণের দাগের উপর লাগান।
- ১৫-২০ মিনিট পর হালকা গরম পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
মসুর ডালের ক্ষতিকর দিক
মসুর ডালের ক্ষতিকর দিকগুলি নিম্নরূপ:
কিডনিতে পাথর: মসুর ডালে অক্সালেট নামক একটি যৌগ থাকে যা কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে। তাই কিডনিতে পাথর বা অক্সালেট জমে থাকার সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের মসুর ডাল কম খাওয়া উচিত।
গ্যাস এবং ফোলাভাব: মসুর ডালে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা পাচনতন্ত্রের মাধ্যমে হজম হতে সময় লাগে। তাই অতিরিক্ত মসুর ডাল খেলে গ্যাস এবং ফোলাভাব হতে পারে।
রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি: মসুর ডালে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন থাকে যা রক্তের ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধি করতে পারে। তাই গাউট বা ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের মসুর ডাল কম খাওয়া উচিত।
অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া: মসুর ডালে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারী কিছু উপাদান থাকতে পারে। তাই অ্যালার্জি সমস্যায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের মসুর ডাল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
FAQ
মসুর ডাল প্রোটিন নাকি কার্বোহাইড্রেট?
মসুর ডাল উভয়ই প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। তবে প্রোটিন এর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট এর তুলনায় বেশি। এক কাপ মসুর ডালে প্রায় ১৭ গ্রাম প্রোটিন এবং ২৩০ ক্যালরি রয়েছে। এছাড়াও এতে ১৫ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার রয়েছে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মসুর ডালে থাকা প্রোটিন শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এটি শরীরের ক্ষয়প্রাপ্ত কোষ পুনর্গঠনে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি পেশী গঠনে, ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে। মসুর ডালে থাকা কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য শক্তির উৎস। এটি দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। সুতরাং বলা যায় যে মসুর ডাল উভয়ই প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট এর ভালো উৎস। তবে প্রোটিন এর পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট এর তুলনায় বেশি।
মুখে মুসুর ডাল দিলে কি হয়?
মুসুর ডাল শুধু খাবারের জন্যই উপকারী নয় ত্বকের যত্নেও এর বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে। মুখে মুসুর ডাল দিলে নিম্নলিখিত উপকারিতাগুলি পাওয়া যায়:
ত্বক উজ্জ্বল ও কোমল হয়: মুসুর ডালে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা ত্বকের কোষগুলিকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং ত্বককে উজ্জ্বল ও কোমল করে তোলে।
ব্রণ দূর হয়: মুসুর ডালে অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান রয়েছে যা ব্রণের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
মেছতা কমে: মুসুর ডালে হাইড্রোকুইনোন নামক একটি উপাদান রয়েছে যা মেছতা কমাতে সাহায্য করে।
ত্বকের মৃত কোষ দূর হয়: মুসুর ডাল স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে যা ত্বকের মৃত কোষ দূর করে ত্বককে মসৃণ ও উজ্জ্বল করে তোলে।
আমাদের আজকের আলোচনা এই পর্যন্তই। এছাড়া আমাদের আর্টিকেল সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।