চুল মানুষের সৌন্দর্যের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। চুলের ঘনতা এবং উজ্জ্বলতা একজন মানুষের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমাদের মাথায় চুল পড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। চুল পড়ার সমস্যাটি শুধুমাত্র একটি শারীরিক সমস্যা নয় এটি মানসিক সমস্যাও সৃষ্টি করতে পারে। তাই চুল পড়ার কারণ এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। চুল পড়ার অনেক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কারণ হল বয়স, জেনেটিক্স, হরমোন, স্বাস্থ্য সমস্যা, ঔষধ, ইত্যাদি। চুল পড়ার কারণ নির্ণয়ের জন্য একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা উচিত। কারণ নির্ণয়ের পর এর চিকিৎসা করা সম্ভব।
Hair fall: চুল পড়ার ১০ টি কারণ.
১. বংশগত কারণ
চুল পড়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ হল বংশগত কারণ। এটি অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটা নামে পরিচিত একটি অবস্থা। এই অবস্থায় জিনগত পরিবর্তন চুলের ফলিকলগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং চুল পড়ার দিকে পরিচালিত করে। অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটা সাধারণত পুরুষদের মধ্যে দেখা যায় তবে মহিলাদের মধ্যেও এটি হতে পারে। বংশগত চুল পড়ার লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয়। প্রথমে মাথার ত্বকের সামনের অংশে চুল পড়তে শুরু করে। তারপর চুল পড়া মাথার ত্বকের উপরের অংশে ছড়িয়ে পড়ে। পুরুষদের মধ্যে চুল পড়ার একটি সাধারণ প্যাটার্ন হল “মাল্টিফোকাল অরেটা” যার ফলে মাথার ত্বকের সামনের এবং উপরের অংশে চুল পড়ে যায়। মহিলাদের ক্ষেত্রে চুল পড়ার একটি সাধারণ প্যাটার্ন হল “অরোফেরিয়ারিয়াল অরেটা”, যার ফলে মাথার ত্বকের সামনের অংশে চুল পড়তে শুরু করে।
২. অতিরিক্ত স্ট্রেস
দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস চুল পড়ার একটি কারণ হতে পারে। স্ট্রেস শরীরে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি করে যা চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে। স্ট্রেসজনিত চুল পড়ার লক্ষণগুলি সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয়। প্রথমে, মাথার ত্বকের উপরের অংশে চুল পড়তে শুরু করে। তারপর, চুল পড়া মাথার ত্বকের পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৩. পুষ্টির অভাব
প্রোটিন, আয়রন, জিংক এবং অন্যান্য পুষ্টির অভাবে চুল পড়তে পারে। বিশেষ করে আয়রনের অভাব মহিলাদের মধ্যে চুল পড়ার একটি সাধারণ কারণ। আয়রনের অভাব রক্তস্বল্পতার দিকে পরিচালিত করতে পারে, যা চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে। পুষ্টির অভাবজনিত চুল পড়ার লক্ষণগুলো সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয়। প্রথমে, মাথার ত্বকের উপরের অংশে চুল পড়তে শুরু করে। তারপর, চুল পড়া মাথার ত্বকের পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৪. ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল পড়তে পারে। এগুলির মধ্যে রয়েছে: অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, অ্যান্টিহিস্টামিন, থেরাপিউটিক রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি। ওষুধজনিত চুল পড়ার লক্ষণগুলি সাধারণত দ্রুত শুরু হয়। প্রথমে, মাথার ত্বকের উপরের অংশে চুল পড়তে শুরু করে। তারপর চুল পড়া মাথার ত্বকের পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
৫. হরমোনাল পরিবর্তন
হরমোনাল পরিবর্তন, যেমন গর্ভধারণ, প্রসব এবং মেনোপজ ইত্যাদির কারণে চুল পড়তে পারে। গর্ভধারণের সময় চুলের বৃদ্ধি বেড়ে যায়। তবে প্রসব পরবর্তী সময়ে চুল পড়ার হার বেড়ে যেতে পারে। এই চুল পড়া সাধারণত সাময়িক এবং ৬-১২ মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। মেনোপজের সময় মহিলাদের মধ্যে হরমোনের মাত্রা পরিবর্তিত হয় যার ফলে চুল পড়তে পারে। এই চুল পড়া সাধারণত স্থায়ী সমস্যা।
৬. থাইরয়েড সমস্যা
থাইরয়েড সমস্যা যেমন হাইপারথাইরয়েডিজম এবং হাইপোথাইরয়েডিজম চুল পড়তে পারে। হাইপারথাইরয়েডিজম হল একটি অবস্থা যাতে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত থাইরয়েড হরমোন তৈরি করে। হাইপারথাইরয়েডিজম চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে যার ফলে চুল পড়া হতে পারে।
৭. ছত্রাক সংক্রমণ
মাথার ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণ যেমন টিনিয়া ক্যাপিটিস চুল পড়ার কারণ হতে পারে। টিনিয়া ক্যাপিটিস হল একটি ছত্রাক সংক্রমণ যা মাথার ত্বককে প্রভাবিত করে। এই সংক্রমণ চুলের গোড়াকে আক্রমণ করতে পারে যার ফলে চুল পড়তে পারে। টিনিয়া ক্যাপিটিসজনিত চুল পড়ার চিকিৎসা নির্ভর করে সংক্রমণের তীব্রতার উপর।
৮. অটোইমিউন রোগ
অটোইমিউন রোগ যেমন অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটার কারণে চুল পড়তে পারে। অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটা হল একটি অটোইমিউন রোগ যা চুলের ফলিকলগুলোকে আক্রমণ করে। এই রোগ চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে যার ফলে চুল পড়া হতে পারে। অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটাজনিত চুল পড়ার চিকিৎসা নেই। তবে কিছু চিকিৎসা চুল পড়ার হার কমাতে পারে।
৯. আঘাত বা অস্ত্রোপচার
মাথায় আঘাত বা অস্ত্রোপচারের ফলে চুল পড়তে পারে। এই ক্ষেত্রে চুল সাধারণত আঘাত বা অস্ত্রোপচারের পর কয়েক মাসের মধ্যে আবার গজাতে শুরু করে।
১০. কেমোথেরাপি
কেমোথেরাপি হল ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলার জন্য ব্যবহৃত এক ধরনের ঔষুধ। এই ঔষুধগুলো চুলের ফলিকলগুলোকেও প্রভাবিত করতে পারে যার ফলে চুল পড়তে পারে। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়া সাধারণত থেরাপি শুরু হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে শুরু হয়। চুল প্রথমে মাথার ত্বকের উপরের অংশে পড়তে শুরু করে। তারপর চুল পড়া মাথার ত্বকের পুরো অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। কেমোথেরাপির কারণে চুল পড়া সাধারণত সাময়িক। থেরাপি শেষ হওয়ার পরে চুল সাধারণত আবার গজাতে শুরু করে।
অল্প বয়সে চুল পড়ার কারণ ও প্রতিকার
অল্প বয়সে চুল পড়ার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
পুরুষত্বের হরমোন (টেস্টোস্টেরন) এর পরিমাণ বৃদ্ধি: পুরুষত্বের হরমোন (টেস্টোস্টেরন) চুলের বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। টেস্টোস্টেরন একটি হরমোন যা পুরুষ এবং মহিলা উভয়ের শরীরে পাওয়া যায়। তবে পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের পরিমাণ মহিলাদের তুলনায় বেশি থাকে। টেস্টোস্টেরন ডিহাইড্রোটেস্টোস্টেরন (ডিএইচটি) নামক একটি হরমোনে রূপান্তরিত হয়। ডিএইচটি চুলের ফলিকলগুলোকে ক্ষতি করতে পারে, যার ফলে চুল পড়া শুরু হয়।
জিনগত প্রবণতা: চুল পড়ার ঝুঁকি জিনগত কারণের জন্য বাড়তে পারে। যদি আপনার পরিবারের ইতিহাসে চুল পড়ার সমস্যা থাকে তাহলে আপনারও চুল পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
পুষ্টির অভাব: চুলের বৃদ্ধির জন্য প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১২ এবং ভিটামিন ডি প্রয়োজন। এই পুষ্টিগুলির অভাব চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে।
মানসিক চাপ: মানসিক চাপ চুল পড়ার কারণ হতে পারে। মানসিক চাপ চুলের ফলিকলগুলোকে ক্ষতি করতে পারে।
অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা: কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন থাইরয়েড সমস্যা, অ্যালোপেসিয়া অ্যারেটা এবং অটোইমিউন রোগ, চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
অল্প বয়সে চুল পড়ার প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গুলো অনুসরণ করা যেতে পারে:
সুষম খাদ্য খান: আপনার খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, আয়রন, জিঙ্ক, ভিটামিন এ, ভিটামিন বি-১২ এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার অন্তর্ভুক্ত করুন।
পর্যাপ্ত ঘুম নিন: প্রতি রাতে ৭-৮ ঘন্টা ঘুম নিন।
স্ট্রেস কমাতে শিখুন: যোগ ব্যায়াম, ধ্যান বা অন্যান্য স্ট্রেস হ্রাস করার কৌশলগুলো চেষ্টা করুন।
আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন: যদি আপনি অল্প বয়সে চুল পড়ার লক্ষণগুলো লক্ষ্য করেন তাহলে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন। আপনার ডাক্তার আপনার চুল পড়ার কারণ নির্ণয় করতে এবং উপযুক্ত চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন।
মেয়েদের অতিরিক্ত চুল পড়ার কারণ ও প্রতিকার
জিনগত কারণ: মেয়েদের চুল পড়ার একটি প্রধান কারণ হল জিনগত কারণ। যদি পরিবারের কারো চুল পড়ার সমস্যা থাকে তাহলে মেয়েদেরও চুল পড়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
পুরুষ হরমোন (টেস্টোস্টেরন) এর পরিমাণ বৃদ্ধি: মেয়েদের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোনও পাওয়া যায়। তবে, যদি এই হরমোনের পরিমাণ বেশি হয়ে যায়, তাহলে তা চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
স্ট্রেস: মানসিক চাপ চুলের বৃদ্ধিকে বাধা দিতে পারে যার ফলে চুল পড়তে পারে।
চুলের যত্নের অভাব: চুলের যত্নের অভাব, যেমন রাসায়নিক প্রসাধনী ব্যবহার, চুল টানা, চুল বেশি গরম পানিতে ধোয়া ইত্যাদি, চুল পড়ার কারণ হতে পারে।
মেয়েদের অতিরিক্ত চুল পড়ার চিকিৎসার জন্য নিম্নলিখিত ওষুধ গুলো ব্যবহার করা যেতে পারে:
মিনোক্সিডিল: মিনোক্সিডিল একটি ওষুধ যা চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে।
ফিনাস্টারাইড: ফিনাস্টারাইড একটি ওষুধ যা ডিএইচটি এর পরিমাণ কমাতে পারে।
প্রপিটেনন: প্রপিটেনন একটি ওষুধ যা মিনোক্সিডিল এর মতো চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে পারে।
চুল প্রতিস্থাপন: চুল প্রতিস্থাপন একটি পদ্ধতি যা চুলের ফাঁকা অংশগুলি পূরণ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
চুল পড়ার স্বাভাবিক পরিমাণ কত?
মানুষের মাথায় গড়ে ১০০,০০০ থেকে ১৫০,০০০ চুল থাকে। প্রতিদিন ১০০ থেকে ১৫০টি চুল পড়া স্বাভাবিক। তবে, যদি এর চেয়ে বেশি চুল পড়ে তাহলে তা উদ্বেগের বিষয়।
চুল পড়া বন্ধ করতে কোন ভিটামিন খেতে হবে?
চুল পড়া বন্ধ করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে নিম্নলিখিত ভিটামিনগুলো খাওয়া যেতে পারে:
ভিটামিন এ: ভিটামিন এ চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে। ভিটামিন এ সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে গাজর, হলুদ, মিষ্টি আলু, পালং শাক, ব্রকলি ইত্যাদি।
ভিটামিন বি-১২: ভিটামিন বি-১২ চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের গোড়া শক্ত করতে সাহায্য করে। ভিটামিন বি-১২ সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, দুগ্ধজাত খাবার ইত্যাদি।
ভিটামিন ডি: ভিটামিন ডি চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে সূর্যমুখী তেল, মাছ, ডিম, মাশরুম ইত্যাদি।
জিঙ্ক: জিঙ্ক চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবারগুলির মধ্যে রয়েছে বাদাম, বীজ, মাংস, সামুদ্রিক খাবার ইত্যাদি।
চুল গজানোর তেলের নাম কি?
চুল গজানোর জন্য অনেক ধরনের তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় তেলগুলি হল:
নারিকেল তেল: নারিকেল তেল চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের গোড়া শক্ত করতে সাহায্য করে।
তিল তেল: তিল তেল চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
অলিভ অয়েল: অলিভ তেল চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের গোড়া শক্ত করতে সাহায্য করে।
আমন্ড অয়েল: আমন্ড অয়েল চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ল্যাভেন্ডার অয়েল: ল্যাভেন্ডার অয়েল চুলের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করতে এবং চুলের খুশকি দূর করতে সাহায্য করে।